পারিবারিক বন্দুকের ব্যবসা বলেই জোড়াসাঁকো নরসিংহ চন্দ্র দাঁয়ের পরিবারের পুজো ‘বন্দুকওয়ালা বাড়ি’-র পুজো নামেই পরিচিত।
বাঁকুড়ার কোতলপুর থেকে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসেছিলেন দয়ারাম দাঁ। তাঁরই উত্তরপুরুষ নরসিংহচন্দ্র দাঁ ১৮৩৫ নাগাদ শুরু করেছিলেন বন্দুকের ব্যবসা। ওল্ড চিনেবাজার স্ট্রিটে তিনি ‘নরসিংহচন্দ্র দাঁ অ্যান্ড কোং গান অ্যান্ড রাইফেল মেকার্স’ নামের এক দোকান খোলেন। পরে এই ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করে তিনি প্রভূত ধনশালী হয়ে ওঠেন। তিনিই ১৮৫৯-এ, তখনকার বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের বসতবাড়িতে, (যা বর্তমানের বিবেকানন্দ রোড) শুরু করেছিলেন দুর্গোৎসব।
অন্যান্য বনেদি পরিবারে ঠাকুরদালানে পুজো হলেও নরসিংহচন্দ্র দাঁয়ের বাড়িতে কোনও নির্দিষ্ট ঠাকুরদালান নেই। দেখে অনুমান করা যায় যে বাড়ির দালান ও উঠোনের কিছুটা অংশ পরবর্তী কালে ঠাকুরদালানে পরিবর্তিত হয়। লোহার থাম-যুক্ত অলঙ্কৃত তিনটি খিলান বাড়ির উঠোন থেকে ঠাকুরদালানটিকে আলাদা করেছে। লোহার ঢালাই করা তিনটি খিলানের কাজ আজও শিল্প রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ডাকের সাজের সুসজ্জিত প্রতিমাকে সাজানো হয় সোনার গয়নায়। রথের দিন হয় কাঠামো পুজো। প্রতিপদের দিন থেকে পুজো শুরু।ষষ্ঠীর দিনে হয় বোধন। সন্ধিপুজোয় নৈবেদ্য হয় এক মন চালের। এই নৈবেদ্য সাজান বাড়ির ছেলেরা। ভোগের মিষ্টি অর্থাৎ পান্তুয়া, গজা, মিহিদানা বাড়িতেই তৈরি হয়। এ ছাড়াও ভোগে থাকে লুচি।
পুজোয় আজও গর্জে ওঠে কামান। দাগা হয় বন্দুক। মাত্র ১৭ ইঞ্চি লম্বা এই কামানটি সে কালে তৈরি করেছিল ‘উইনচেস্টার রিপিটিং আর্মস’ কোম্পানি। দেখতে ছোট হলেও তার সব কিছুই আসল কামানের মতো। আর অতীতের ঐতিহ্য বজায় রাখতে আজও দুর্গাপুজোয় কামান দাগা হয় জোড়াসাঁকো অঞ্চলে বিবেকানন্দ রোডের উপর নরসিংহচন্দ্র দাঁয়ের বাড়ির পুজোয়।
নবমীর দিন হয় কুমারী পুজো। তবে এই পরিবারের রীতি অনুসারে বাড়ির অন্যান্য কুমারীদেরও মণ্ডপে সাজিয়ে বসানো হয় এবং পরিবারের সদস্যরা তাদের হাতে নানা ধরনের উপহার তুলে দেন। এ বাড়িতে পুরনো প্রথা মেনে সন্ধিপুজোয় আজও ছাদে বন্দুক ও কামান দাগা হয়। সপ্তমীর দিন সকালে রুপোর ছাতা মাথায় দিয়ে গঙ্গাস্নানে যান নবপত্রিকা। পারিবারিক বন্দুকের ব্যবসা বলেই আজও নবপত্রিকা স্নান এবং বিসর্জনের সময় পুলিশের অনুমতি নিয়ে প্রতিমার সঙ্গে থাকেন চার জন সশস্ত্র প্রহরী। তাদের হাতে থাকে তরোয়াল। দশমীর দিন বাড়ি থেকে প্রতিমা বেরনোর আগে যখন সাতপাক ঘোরানো হয় তখনও বন্দুক দাগা হয়।
আগে দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর রীতি থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ। তেমনই আগে বাহকের কাঁধে চেপে দু্র্গাপ্রতিমা বিসর্জনে যেতেন। দু’টি নৌকার মাঝখানে রেখে প্রতিমাটি মাঝগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে বিসর্জন হত। এখন অবশ্য আর তা হয় না। তবু এই পরিবারের অপরূপ প্রতিমা দেখতে আজও ভিড় করেন বহু মানুষ।