Advertisement
Durga Puja 2020

অতিমারির পুজোয় গঙ্গা বাঁচানোর ডাক ক্যামডেনের মণ্ডপে

সময়টা ১৯৬৩। লন্ডনে বসবাসকারী কিছু বাঙালি তরুণ শারদ-আনন্দের  রেশটাকেই টেনে এনেছিলেন টেমস-এর তীরে, ক্যামডেনের মণ্ডপে।

সুমনা আদক
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৩০
Share: Save:

এই অতিমারির কালেও ক্যালেন্ডারের পাতার দিনগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিউলি ঝরা আশ্বিনের শারদ প্রাতে আগমনীর সুর বেজে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মন্দ্র কণ্ঠে। জানান দিয়ে যায়, "মা আসছেন"। কিন্তু ২০২০-র এই উলটপুরাণে প্রবাসে পুজোর ছবিটাই বদলে গিয়েছে আমূল। লন্ডনে এ বারের দুর্গাপুজোর হুজুগ অনেকটাই কম।

এতকাল ব্রিটেনে ষাটের বেশি পুজো কমিটির রেষারেষি ছিল তুঙ্গে। এ বছর মাত্র পনেরোটা মণ্ডপে 'মা’ আসছেন লন্ডনে। বার্মিংহ্যাম, সাউথ লন্ডন, কেমব্রিজ, আবার্ডিন, কার্ডিফ, বাঙালি কালচার অ্যাসোসিয়েশন, ওয়েলস-এর ঘট পুজো, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো, এডিনবরা- এমন বহু জায়গায় পুজো বন্ধের খবর লন্ডনের অনেক বাঙালির কাছেই প্রায় স্বপ্নভঙ্গের মতো।

তবে এমন বিষন্ন সময়ে পুজো উদ্যোক্তারাই যখন অনিশ্চয়তায় দিন গুনছে, তখন সুইস স্কটিশ লাইব্রেরির এক মণ্ডপে আঁকা হচ্ছে উমার পদচিহ্ন। এই আকালেও ব্রিটেনের মাটিতে শারদোৎসবের বেরঙিন আমেজটাকে কিছুটা হলেও রাঙিয়ে দিতে চেষ্টা করছে মিত্তলদের বহু পুরনো এই পুজো।

আরও পড়ুন: মিলেমিশে উৎসবে মাতা হচ্ছে না সিডনির

সময়টা ১৯৬৩। লন্ডনে বসবাসকারী কিছু বাঙালি তরুণ শারদ-আনন্দের রেশটাকেই টেনে এনেছিলেন টেমস-এর তীরে, ক্যামডেনের মণ্ডপে। শোনা যায় স্বয়ং অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ মহাশয় জাহাজে করে সুদূর কুমোরটুলি থেকে দুর্গাপ্রতিমা পাঠিয়েছিলেন এই লন্ডনে। ভাবে-ভক্তিতে মিলেমিশে দেখতে দেখতে ৫৬টা শরৎ পার করে আজও অমলিন সুপ্রাচীন এই পুজো। ষষ্ঠীর সকালে রীতিমতো শোভাযাত্রা করে 'লন্ডন মিউজিয়াম' থেকে মা আসেন ক্যামডেনের মণ্ডপে। আহা! প্রতি বছর বিদেশের মাটিতে এমন দৃশ্য প্রবাসে থাকা যে কোনও বাঙালির কাছেই বড় আবেগের।

এ বছর থিমের চালচিত্রে উঠে এসেছে ‘নমামি গঙ্গে’।

করোনার দাপটে এ বছরটায় ফিকে হয়েছে একের পর এক উৎসবের আনন্দ। কিন্তু নিয়ম মতো টেমসের ধারে খুঁটিপুজোর দিনের ছবিটাই বলে দিয়েছিল- পৃথিবীর সবথেকে বড়ো কার্নিভাল যে কোনও অশুভ শক্তির চোখরাঙানিকে কেমন অনায়াসে উপেক্ষা করতে পারে! ভারতীয় নিয়ম নীতির নির্ধারিত সময়ে প্রতি বারের মতো এ বছরও মায়ের বোধন থেকে অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধি পূজা থেকে কুমারী পূজা, ধুনুচি নাচে তাল মিলিয়ে মায়ের বিদায়বেলায় সিঁদুর খেলা- সবই হবে আগের মতো। তবে ব্রিটেনের কোভিড পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে মণ্ডপে লোকসমাগমের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন পুজো উদ্যোক্তারা।

আরও পড়ুন: কোভিড-হীন তাইওয়ানে পুজোয় সামিল বাঙালিরা

আনন্দ আড্ডা, স্টাইল সেগমেন্ট, ফটো সেশন, প্রসাদ বিতরণী হয়ে বারবেলায় পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া- প্রতি বার ক্যামডেনের পুজোর দিনগুলো যেন সাগর পারে উঠে আসা এক টুকরো সাবেক কলকাতা! তবে এখানেই শেষ নয়। এ বছর থিমের চালচিত্রে উঠে এসেছে ‘নমামি গঙ্গে’-র মতো অভিনব এক পরিবেশ রক্ষার ভাবনা। সত্যিই তো এখন না ভাবলে আর ভাবব কখন টেমস কিংবা গঙ্গার কথা? আমরাই তো শুধু পারি এদের বাঁচাতে। প্যান্ডেলের চার দিকে ছড়িয়ে রয়েছে থিমের কোলাজ। এ বছর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পুরোপুরি ব্রাত্য নয় এখানে। শোনা যাচ্ছে, সরকারি অনুমতি নিয়ে কোভিড পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই মাত্র পনেরো জন করে অংশগ্রহণ করবে এক একটা টিমে। "বিষবৃক্ষ" দিয়ে সূচনা হয়ে অনুষ্ঠানের শেষ দিনে থাকবে ‘অলবিদা’-এ বছর বলিউডের হারিয়ে যাওয়া শিল্পীদের নিয়ে বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান এবং তাঁদের স্মৃতিরোমন্থন।

বাঙালির দুর্গাপুজো বলে কথা! সাজগোজের দিকটা নিয়েও বেশ ভাবতে হবে বৈকি! পুজোর দিনগুলোতে 'পূজা বাজার' হাজির হবে প্যান্ডেলে। রসনা-বিলাসী বাঙালিকে মিষ্টি মুখ করাতে পুজোর সময়ে থাকবেন গুপ্ত সুইটস, আর সিরাজ আয়োজন করবে তার বিখ্যাত সব ভারতীয় মোগলাই খানা থেকে বাঙালি ভূরিভোজের।

ঐতিহ্যবাহী লন্ডনের মাটিতে ক্যামডেনের পুজোটা দেশবিদেশের নজর টানে প্রতিবারই। তা কি শুধুই তার জৌলুসে? প্রশ্নটা প্রতি বারই যেন ঘুরপাক খায়। এত প্রতিযোগিতার বাজারে উৎসবেও যেখানে টেক্কা দেওয়ার পালা, সেখানে কোভিডের মতো বিরাট ধাক্কা সামলেও দীর্ঘ ছাপ্পান্ন বছর ধরে একটা কমিটি কেমন করে তাদের পুজোটাকে একটা পরিবারের মতো বেঁধে রাখল- সেটাই দেখার মতো। কমিটির প্রেসিডেন্ট, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডক্টর আনন্দ গুপ্ত জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, “আমাদের পুজো প্রাঙ্গণটা সত্যিই একটা পরিবার। যেন বাঙালির নির্ভেজাল বৈঠকখানা- যেখানে সারা বছরের কর্মব্যস্ততা ভুলে পুজোর দিনগুলিতে মানুষ ছুটে আসে মায়ের দর্শন করতে। প্রবাসের মাটিতে এমন শারদসমাগমের থেকে বেশি কিছু হতেই পারে না। এত কঠিন দিনেও আমাদের সার্বিক উদ্যোগ নেওয়ার যাবতীয় শক্তির আধার আমাদের একমাত্র 'শক্তিধারিণী'। আশা রাখি, আমরা এ বারও সব সুষ্ঠু ভাবে করতে পারব।” কমিটির প্রত্যেকেই উৎসবের শুরুর দিন থেকে শেষ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রমে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের শখের পুজোটিকে। সবার প্রার্থনা একটাই- মহাশক্তির আগমনে এ বার বিলীন হোক অতিমারির অশুভ সময়।

ছবি সৌজন্য: লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE