Advertisement
Durga Puja Celebration

মনমিষ্টি-পদ্মচক্র পাখার হাওয়ায় দেবতারাও শরীর জুড়োতেন

ধুতি-ফতুয়া পরা জ্যান্ত পাঙ্খাপুলারকে জীবনে প্রথম দেখে হাঁ-করে তাকিয়ে ছিলাম।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৫:৫০
Share: Save:

মানুষ যা যা করে নিজে খুশি হয়, সেইগুলোই সে দেওয়ার চেষ্টা করে তার আরাধ্যকে। নিজের পছন্দের খাবার, পছন্দের পোশাক, পছন্দের শয্যা সে তার পছন্দের দেবদেবীকে ভক্তিভরে নিবেদন করে। পরে সেই সব প্রসাদি জিনিসপত্র নিজে গ্রহণ করে যারপরনাই আহ্লাদিত হয়। দেবদেবীরা এমনিতেই স্বভাবলাজুক। তাঁরা মুখফুটে বলতে পারেন না যে, দুপুরের দিকে গোবিন্দভোগ চালের মিষ্টি-মিষ্টি খিচুড়ি দিয়ে শুকনো শুকনো আলুদ্দম সেবা করতে তাঁদের ভাল লাগে। ফাইন সুতোর শান্তিপুরি ধুতি কিংবা পাড়ে ঘন কাঁথাস্টিচের কাজ করা হালকা রঙের সিল্কের শাড়ি তাঁদের অতি প্রিয়। আবার, মাথার বালিশের সঙ্গে দু-পাশে দু’টি স্যাটিনের খোলওয়ালা নরম পাশবালিশ ছাড়া রাতে তাঁদের ঘুম আসে না। কিন্তু এক জন প্রকৃত ভক্ত বা সেবায়েত এগুলো সবই বুঝতে পারে। তারা জানে দেবদেবী মাত্রেই জাগ্রত। তাঁদেরও মানুষের মতোই খিদে, তেষ্টা, ঘুম আছে। অন্তরীক্ষ থেকে স্ফটিকস্বচ্ছ বৃষ্টিফোঁটা সন্ধের মুখে জুঁইগাছের ওপর ঝরে পড়লে আমাদের মতো তাঁদের নাকেও স্নিগ্ধ সুগন্ধ ভেসে আসে। তাঁদেরও শীতকালে শীত করে, গরমকালে আইঢাই গরম হয়।

আমাদের বাংলা গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল। আগে দূষণ কম ছিল বলে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি বাতাসে বেশ খানিকটা শিরশিরে হিম মিশে গেলেও, মাসের শুরুটা কিন্তু পচা-ভাদ্রর মতো ভ্যাপসাই ছিল। আর দুগ্‌গা পুজো যেহেতু তিথি অনু্যায়ী আশ্বিন মাসের যে কোনও সময়েই পড়তে পারে, তাই মায়ের গরম লাগা দূর করার জন্যে নিষ্ঠাবান রাজারাজড়া-সামন্ত-জমিদারেরা অতি প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন। মা দুগ্‌গা তো সকলের মা। তাঁর গরম করছে অথচ তার কোনও সুরাহা হবে না, এ আবার কেমন কথা! এ জন্য দুগ্‌গা পুজো শুরু হওয়ার সময় থেকেই দেবীকে চামর দিয়ে বাতাস করা হত। প্রাচীনকালে ভারতীয় রাজাদের তো বটেই, রাজদরবারে মোগল বাদশাদেরও হাওয়া করা হত ওই ঘি-রঙা রেশমি চামর দিয়ে। লক্ষ্মণ, সিংহাসনে বসা রঘুপতিকে চামর দিয়ে বাতাস করছেন, এমন একটি ছবি তো রামায়ণের শেষের দিকেও যত্ন করে আঁকা হয়েছে। চমর-মৃগ বা চমরিগাইয়ের ল্যাজের লোম দিয়ে বানানো হত বলেই এর নাম হয়েছিল চামর। কোনও কোনও দুর্গাপ্রতিমার দু-ধারে লক্ষ্মী-সরস্বতীর বদলে জয়া ও বিজয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এঁদের দুজনের হাতেই থাকে চামর। এমন চামরিণীদের উপস্থিতি নানা প্রাচীন মন্দিরের গায়ে দুর্গাপ্রতিমার খোদাইমূর্তিতেও দেখতে পাওয়া গেছে। কেউ বলেন, এঁরা দুর্গারই কন্যা। আবার কারও মতে, এঁরা দেবীর দুই সখী, যাঁরা চামর দিয়ে তাঁকে নিয়ত ব্যজন করে চলেন। তাই দুর্গাপুজোর নিয়মবিধির মধ্যেও দেবীকে চামর ঘুরিয়ে বাতাস করার রীতিটি আজও বজায় রয়েছে।

চামরের পরে গরম নিবারণের জন্য এল তালগাছের পাতা দিয়ে বানানো এক ধরনের বড়সড় পাখা। এর হাতল ছিল লম্বা এবং পেটটি ছিল ছড়ানো। পাখাটির পেটের মধ্যে রং-তুলি দিয়ে ফুল-লতা-পাতা-পাখি, এমন নানান রঙিন ছবি আঁকা থাকত। হাতলেও করা থাকত চিত্রবিচিত্র কারুকাজ। এই পাখার বাইরের পরিধি জুড়ে সেলাই করে আটকে দেওয়া হত একটি লাল রঙের কুঁচি দেওয়া কাপড়। পাখা নাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ওই লাল কাপড়টি প্রজাপতির ডানার মতো ফুরফুর করে উড়ত, যা দেখতে লাগত চমৎকার। রাজকীয় পাখা— তাই রাজপাখা। একসময় এই পাখা দিয়েই সম্ভ্রান্ত জমিদারবাড়ির পুজোমণ্ডপে পাখাবর্দারেরা দেবীকে হাওয়া করে যেত। এই পাখাটিকে বর্ধমান এবং শান্তিপুরের কোনও কোনও জায়গায় রাজপাখা বলে উল্লেখ করা হয়। কাশীর রামনগরের রাজবাড়িতে হাতির দাঁতের কাজ করা অপূর্ব সব রাজপাখা সাজিয়ে রাখা আছে। এই পাখাটির ছোট সংস্করণই হল আমাদের আটপৌরে ‘হাতপাখা’। বাংলার দরিদ্র গৃহবধূরা, তালপাতার সঙ্গে রঙিন কাপড়, বাঁশের কঞ্চি, বেতের ছড়ি, কাশফুলের ডাঁটি, ছুঁচ-সুতো, এমন নানা টুকিটাকি জিনিস জড়ো করে অবসর সময়ে অসামান্য সব হাতপাখা তৈরি করে বাংলার কুটিরশিল্পকে তিলে তিলে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। তাদের হাত থেকেই বেরিয়ে ছিল মনমোহিনী পাখা, গঙ্গাগোবিন্দ পাখা, মনমিষ্টি পাখা, পদ্মচক্র পাখা— এমন সব নকশিপাখার ঢল। যার হাওয়া খেয়ে মানুষের পাশাপাশি দেবদেবীরাও বোধহয় নিজের শরীর জুড়োতেন।

আরও পড়ুন: নাটক হয়ে গেলেও চরিত্রের নাম ধরে ডাকা চলত বহু দিন​

আরও পড়ুন: পকেটমারি তো ‘হস্তশিল্প’-র বাইরে নয় রে বাবা!​

রাজপাখা এবং হাতপাখার যুগ স্থায়ী হয়েছিল অনেক দিন। তার পর যে দিন টানাপাখা এল, সে দিন বাংলার জমিদারবাবুরা তাঁদের দুর্গামণ্ডপে সেই ঝুলন্ত পাখা লাগিয়ে চমকে দিয়েছিলেন এলাকার সাধারণ লোকজনকে। যার পাখার যত বড় ঝালর, যত সুন্দর জরি বসানো কারুকাজ, যত নিখুঁত আঁকা ছবির আঁকিবুকি, সেই বাবুর তত নাম, তত খ্যাতি। আমাদের ছেলেবেলায় মধ্য কলকাতার দু-একটি প্রাচীন বাড়ির পুজোমণ্ডপে যে টানাপাখা দেখেছিলাম, তা এখনও আমার আবছা মনে আছে। কিন্তু সেই বাড়িগুলো যে কী কী তা আমার স্পষ্ট মনে নেই।

গত বছর, মানে ২০১৭ সনের পুজোর সময় শান্তিনিকেতনের অদূরে অজয় নদের পাড়ে কাশফুল দেখতে গিয়েছিলাম সপরিবার। গ্রামের একটি প্রাচীন বাড়ির পুজোমণ্ডপে ঢুকে দেখলাম, মা দুর্গার মাথার ওপরে একটি সুদৃশ্য টানা-পাখা একমনে টেনে চলেছেন এক জন মাঝবয়সী শীর্ণ মানুষ। দেখে তো আমি শিহরিত! এই সেই পাঙ্খাপুলার! মনে পড়ে গেল, এক লালমুখো সাহেব মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখল, তার ঘরের ঠিক বাইরে বসে থাকা নেটিভ পাঙ্খাপুলার, সারা দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়েছে মাটিতে। তার হাত থেকে খসে পড়েছে টানাপাখার দড়ি। আর তাই, পিনপিন মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে গেছে সাহেবের। এই অপরাধে, ওই রোগা পাঙ্খাপুলারের গলার ওপর নিজের একটা গোদা পা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে, সে জিভ বের করে মুখে রক্ত উঠে মারা না যাওয়া অব্দি শান্ত হতে পারল না সেই সাহেব। তার পর বেডরুমে ঢুকে, এক পেগ হুইস্কি ঢকঢক করে গলায় ঢেলে, আবার খাটের ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল। সত্যি, এমন গল্প কতই না পড়েছি! তাই ধুতি-ফতুয়া পরা এক জন জ্যান্ত পাঙ্খাপুলারকে জীবনে প্রথম বার দেখে, তার আঁকাবাঁকা দাগে ভরা নিষ্পাপ মুখটার দিকে অনেক ক্ষণ হাঁ-করে তাকিয়ে থাকাটা, আমার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

টানাপাখার দিন শেষ হওয়ার পর বাঙালি বাড়িতে হাঁড়িতে ব্লেড-জোড়া বিজলি পাখা এল। পুজোমণ্ডপের উঁচু প্যান্ডেলের ছাদ থেকে লম্বা লোহার রড নামিয়ে, তার শেষ মাথায় সেই পাখা ঝুলিয়ে দেওয়া হত। অবশ্য পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে আরতি করার সময় বা ধূপ-দীপ জ্বালানোর মুহূর্তে তা বন্ধ করে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। টানা পাখার বেলাতেও যে এই অসুবিধেটা ছিল না তা নয়। কিন্তু হাতের টানে কন্ট্রোল করা যেত বলে ওটাকে তখন আরও আস্তে চালানো সম্ভব ছিল। এর পর মানুষের জীবনের গতি যখন হু হু করে বেড়ে গেল, তখন তার উড়িয়ে হাওয়া খাওয়ার ইচ্ছেটাও গেল বেড়ে। ঘরে ঘরে এল পেডেস্টাল ফ্যান।

হাওয়া-কলের পাখার মতো তার বড় বড় ব্লেডগুলো থেকে যে ঝড়ের মতো হাওয়া বেরত, তাতে মায়ের শোলার সাজ যেত ঘেঁটে। সিংহের কেশর উঠত ফুলে। কার্তিকের মুকুট যেত বেঁকে। এমনকি, গণেশকে অবাক করে দিয়ে কলাবউয়ের ঘোমটাও যেত খুলে। তাই মণ্ডপে সেটাকে চালু রাখাই একটা বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়াল। এ দিকে বাংলার বুকে গরম বাড়ছে। ঝাঁ ঝাঁ করে বাড়ছে কলকারখানা। যদু-মধু-কানাই-বলাই সবাই চারচাকা করে অফিস যেতে শুরু করেছে। মহাকাশের ওজোন গ্যাসের স্তর ছ্যাঁদা হয়ে গিয়ে শোঁ শোঁ করে অতিবেগুনি রশ্মি এসে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। ফলে মা ধড়াচুড়ো পরে দরদর করে ঘামছেন। গণেশদাদা ঘামছে। অসুর ঘামছে। লক্ষ্মীঠাকরুণ, সরস্বতী ঠাকরুণের প্রসাধন গাল গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা নেমে আসছে।

তা হলে কী করা যায়! পুরনো দিনের রায়বাহাদুর, রায়সাহেব, রায়রায়ানদের মতো কলকাতা তথা বাংলার বড় বড় ক্লাবের পুজো-উদ্যোক্তারা নিজের জীবন থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতা থেকে অবশেষে বুঝতে পারলেন, যা-ই হোক আর তা-ই হোক, মাকে এসি ছাড়া রাখলে চলবে না! কারণ, তিনি এক বার বিগড়ে গেলে সৃষ্টি রসাতলে যাবে! ব্যোমভোলার চোদ্দোপুরুষের ক্ষমতা নেই তাঁর সেই গরম মাথা ফুঁ দিয়ে দিয়ে জুড়িয়ে দেবেন। তাই সমস্ত নামী পুজো প্যান্ডেলের ভেতরটা এখন ঠান্ডা কনকনে। আর এই ভাবেই চামর থেকে এয়ার কন্ডিশনার— মানুষের উষ্ণ থেকে শীতল হওয়ার অদম্য বাসনা, রক্তমাংসের পার্থিব দেহ থেকে আস্তে আস্তে চারিয়ে গেল প্রতিমার রংমাটির অপার্থিব শরীরে।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE