‘ধনলক্ষ্মী’ হল মা লক্ষ্মীর সবচেয়ে জনপ্রিয়।
এমন তো কত জনেরই হয়, পাঁচনে নিয়মিত মিছরি মিশিয়ে চলেছেন কিন্তু খুকখুকে কাশিটা আর সারছে না। আসলে, সাধারণ মিছরির বদলে তাতে যে তালমিছরি দেওয়ার ছিল, সেটা তাঁর জানা ছিল না। আবার কখনও দেখা যায়, মুদি দোকান থেকে সোডা কিনে এনে, দিনের পর দিন পুরনো ধুতি কাচা হচ্ছে, কিন্তু তার হলদেটে ছোপ আর যাচ্ছে না। কী করে যাবে বলুন? দেওয়ার কথা কাপড় কাচার সোডা, দেওয়া হচ্ছে রান্না করার সোডা। তাতে দাগ যায় কোনও দিন? যেমন আমরা দেখি, কোনও নিষ্ঠাবান ভক্ত দিনরাত এক করে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করে চলেছে, কিন্তু তার মনোবাঞ্ছা কিছুতেই পূর্ণ হচ্ছে না। সে ভাবছে, তার ভক্তিতে নিশ্চয়ই কোনও ত্রুটি আছে। খামতি আছে। আসলে তো তা নয়। ভক্তের বিশেষ বিশেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য, মা লক্ষ্মীর বিশেষ বিশেষ রূপ আছে, এটা তো সেই ভক্তকে সবার আগে জানতে হবে। এক জন অর্থোপেডিক সার্জেন কী দেখেন, না, হাড়। আবার ওই হাড়ের মধ্যে হাত, পা, শিরদাঁড়া, কোমর— এমন নানা এরিয়া ভাগ করা থাকে। মানে, তাঁরা হলেন ওই সব নির্দিষ্ট জায়গার হাড়ের অসুবিধে দূর করার স্পেশালিস্ট। তেমনই ভক্তকেও নিজের প্রকৃত অসুবিধে দূর করতে হলে, সৌভাগ্যের মুখ দেখতে হলে, মা লক্ষ্মীর সেই স্পেশাল রূপটির শরণাপন্ন হতে হবে। নইলে কোনও ফলই মিলবে না।
প্রিয় পাঠক, আসুন, এই বার মা লক্ষ্মীর সেই বিশেষ বিশেষ রূপগুলি খুব সংক্ষেপে আপনাদের জানিয়ে দিই। আমাদের শাস্ত্রে আট ধরনের লক্ষ্মীর কথা খুব বিস্তারিত ভাবে পাওয়া গিয়েছে। এদের মধ্যে প্রথমেই হলেন ‘আদিলক্ষ্মী’। অনেকের মতে, ইনি সাগররাজার কন্যা। সমুদ্রমন্থনের সময় অমৃতের সঙ্গে ইনিও উঠে এসেছিলেন। বিয়ে করেছিলেন বিষ্ণুকে। এঁর আর এক নাম ‘মহালক্ষ্মী’। এঁর আশীর্বাদ পেলে মানুষ নাকি অমরত্ব লাভ করতে পারে। কিন্তু লোভ-লালসা-মোহ-মায়ার ঊর্ধ্বে উঠে সে সাধনা করা খুবই কঠিন ব্যাপার। বাঙালির পক্ষে তো তা আরওই দুষ্কর। কারণ, এর মাঝে ফুলকো লুচির আকর্ষণ আছে। ল্যাজওয়ালা বেগুনভাজার মোহিনী মায়া আছে। কুচি কুচি নারকোল ছড়ানো ছোলার ডালের মায়াবী লাস্য আছে। রাবড়ির শিরশিরে ইশারা আছে। অপ্সরা-কিন্নরীদের প্রাণপণে চোখ বুজে যদি বা ঠেকিয়ে রাখা যায়, নিজের ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে ‘সিল’ করে দেওয়া যাবে কী ভাবে?
‘ধনলক্ষ্মী’ হল মা লক্ষ্মীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি রূপ। ইনি ভক্তের উপর সদয় হলে তাকে সোনাদানা, অর্থ ও ধনসম্পদে ভরিয়ে দেন। ইদানীং কালীপুজোর সময় অবাঙালিদের ‘ধনতেরাস’ উপলক্ষ্যে, বিভিন্ন নামী-দামি গয়নার দোকানের বিজ্ঞাপনে, আমরা ‘ধনলক্ষ্মী’ শব্দটি দেখতে পাচ্ছি। সঙ্গে আর একটি শব্দও যোগ হয়েছে, ‘ধনবর্ষা’। ধনের বর্ষা— তাই ধনবর্ষা! মনে হয় ওই গয়নার দোকানগুলিই মন দিয়ে এই ধনলক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করে এবং যথাযোগ্য ফল পায়। গড়পড়তা বাঙালি এঁকে নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামায় না।
আরও পড়ুন: মনমিষ্টি-পদ্মচক্র পাখার হাওয়ায় দেবতারাও শরীর জুড়োতেন
এর পর লক্ষ্মীদেবীর যে প্রাচীন রূপটির কথা বলব, তা হল ‘ধান্যলক্ষ্মী’। ইনি কৃষকদের দেবী। মাঠ-ভরা ধান, গম, ডাল, শস্য এঁরই কৃপায় ফলে থাকে। ধান হল মা লক্ষ্মীর আর একটি রূপ। তাই এই দেবীর হাতেও ধানের ছড়া থাকে। কারও গোলা ভরা ধান মানেই সেই কৃষকের উপর দেবী প্রসন্না হয়েছেন, এইটাই বুঝে নিতে হবে। আর কৃষকের পেট ভরছে মানে, জগৎ সংসারের সবারই পেট ভরছে, এই হল সাদা হিসেব।
‘গজলক্ষ্মী’ হলেন সেই দেবী যাঁর কৃপায় পশুপালন এবং পশুজাতীয় সম্পত্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে ভক্তের ঘরে ধনসম্পদ আসে। এঁর দু’-পাশে তাই সবসময় দু’টি শিক্ষিত সাদা হাতিকে দেখতে পাওয়া যায়, যারা ঘড়ায় করে দেবীর মাথায় ননস্টপ পবিত্র জল ঢেলে চলেছে। পুরাণ বলে, দেবরাজ ইন্দ্রের সাদা ঐরাবতটিও নাকি দেবী গজলক্ষ্মীরই গিফট করা। জমিতে লাঙল দেওয়া, রথ চালানো, ভ্রমণ, যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে দেশ রক্ষা— এমন নানা কাজে পশুর ব্যবহার অতি প্রাচীনকাল থেকে। খাদ্য হিসেবে পশুমাংস ভক্ষণের ইতিহাসটি এই পবিত্র রচনার মধ্যে আমি সচেতন ভাবেই আর টেনে আনলাম না। শুধু পাঠককে এইটুকুই ধরিয়ে দিতে চাইলাম যে ধনসম্পদ চেয়ে বা সংসারে একটি সন্তানের কামনা করে কোনও পরিবার যদি ভক্তিভরে গজলক্ষ্মীর আরাধনা করে, তবে তা থেকে কিন্তু ততটা ফল পাওয়া যাবে না। উল্টে, সন্তান হলে, সে জমিতে হাল টানার যোগ্য বলেও বিবেচিত হতে পারে।
ফুটফুটে সন্তান হওয়ার জন্য লক্ষ্মীদেবীর যে আরাধ্য রূপ, তা হল ‘সন্তানলক্ষ্মী’। এই রূপে দেবীর বাম দিকের কোলে সবসময় একটি শিশুপুত্র বসে থাকে। তার হাতে হয় একটি লাড্ডু, নয় একটি পদ্মফুল। কোনও ছবিতেই কিন্তু শিশুকন্যা দেখনি। শিশুকন্যা বসে থাকলে কার যে কী ক্ষতি হত, বুঝি না। স্বামী-স্ত্রী মন দিয়ে লক্ষ্মীপুজো করছে। সংসারে অর্থের দরকার, সম্পদের দরকার। অথচ একটির পর একটি শিশু জন্ম নিয়ে চলেছে। তাদের ভরণপোষণ ঠিক ভাবে করবার অর্থটুকুও নেই। এ ছবি তো চারের দশক থেকে সাতের দশক পর্যন্ত বাঙালি জীবনের এক মেঘলা প্রতিচ্ছবি। কেউ বোঝেনি, কেউ বোঝবার চেষ্টাও করেনি, ওই পরিবারগুলি ধনলক্ষ্মীর স্তব করতে গিয়ে সন্তানলক্ষ্মীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে চলেছে প্রতি বৃহস্পতিবার। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। দেবীর আর দোষ কী? তিনি মা বই তো নন! নিজের বুকে হাত রেখেই বলুন না, আপনি হলে কী করতেন? গেরস্তকে ডজনখানেক আন্ডাবাচ্চা উপহার হিসেবে দিতেন না?
আরও পড়ুন: নাটক হয়ে গেলেও চরিত্রের নাম ধরে ডাকা চলত বহু দিন
এ বার লক্ষ্মীদেবীর পরপর যে দু’টি রূপের কথা আপনাদের বলব, চেহারার বিচারে তাঁদের তফাত খুবই কম। যার প্রথমটি হল ‘বীরলক্ষ্মী’ আর দ্বিতীয়টি হল ‘বিজয়লক্ষ্মী’। অনেক জায়গাতেই বীরলক্ষ্মীকে ‘ধৈর্যলক্ষ্মী’ আর বিজয়লক্ষ্মীকে ‘জয়লক্ষ্মী’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এই দুটি রূপেই তাঁদের হাতগুলি নানা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও চেহারায় তফাৎ তো রয়েইছে কিছু— কখনও অস্ত্রে, কখনও বা শাড়ির রঙে। বীরলক্ষ্মী তাঁর ভক্তকে শক্তি, সাহস এবং উদ্যম জোগান, যাতে সে নিজের জীবনের নানা বাধাবন্ধন এবং সমস্যার কাছে হেরে না যায়। যাতে সে মাথা ঠান্ডা রেখে ধৈর্য সহকারে বীরের মতো সেগুলোকে জয় করতে পারে। আর বিজয়লক্ষ্মী রূপে দেবী তাঁর ভক্তকে অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করতে সাহায্য করেন। ভক্ত যাতে তার নিজের শরীরের ভেতরের শত্রু, মানে ষড়রিপুকেও যুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারে, তার আশীর্বাদ করেন। বাইরের যুদ্ধ এক রকম। কিন্তু ভেতরের যুদ্ধ বড় কঠিন জিনিস। সেই যুদ্ধে জেতা খুব সহজ নয়।
এই বার মা লক্ষ্মীর শেষ যে রূপটি নিয়ে আলোচনা করব, তিনি হলেন ‘বিদ্যালক্ষ্মী’। হ্যাঁ, সুধী পাঠক, শুনে ঘাবড়ে যাবেন না! ‘রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী’ নামক যে বাংলা প্রবাদটি শুনে শুনে আপনাদের কান পচে গিয়েছে, প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য ও পুরাণ কিন্তু সে কথা বলে না। বিদ্যালক্ষ্মী তাঁর সাধককে মানব জীবনের সবচেয়ে দামি ঐশ্বর্য, জ্ঞান নামক সম্পদটি লাভ করার আশীর্বাদ করেন। মা লক্ষ্মীর যতগুলি রূপ, তার মধ্যে একমাত্র এঁর পরনেই সাদা রঙের দিদিমণি দিদিমণি শাড়ি। মুখে একটা প্রশ্রয়ের হাসি। যেন ক্লাসের বাচ্চারা দুষ্টুমি করলেও তিনি ততটা জোরে ধমকে উঠবেন না। তাদের ভালবেসে অনেকটাই স্নেহ করবেন। অনেক সময় খবরের কাগজে খবর বেরোয়, অতি দরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তান, সর্বভারতীয় কোনও পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছে। সেগুলো কিন্তু আর কিছুই নয়। আসলে, সেই দীনমজুর বা রিকশাচালক বাবা-মা, অর্থ বা ধনসম্পদের জন্যে ধনলক্ষ্মীর সাধনা না করে, আধপেটা খেয়ে, সারা দিন পাগলের মতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে নিজের ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে ‘বিদ্যালক্ষ্মী’র আরাধনা করেছেন। ভাল থাকব, ভাল খাব, ভাল পরব— এই জিনিসগুলোকে কাদামাটির মতো তুচ্ছ করে দেখেছেন। তাই দেবী, নিজস্ব স্বভাবে যথেষ্ট চঞ্চলা হলেও, বিদ্যার প্রতি তাঁদের ভালবাসা দেখে, শেষ পর্যন্ত আর বিট্রে করতে পারেননি। অন্তরীক্ষে বসে দু-হাতে অভয়-মুদ্রা দেখিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসেছেন।
এত ক্ষণ ধরে আপনাদের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর যে সমস্ত রূপ নিয়ে আলোচনা করলাম, তাঁদের নানা রূপে হাতের সংখ্যা বিভিন্ন। যেমন, আদিলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী, গজলক্ষ্মী এবং বিদ্যালক্ষ্মীর চারটি করে হাত। সন্তানলক্ষ্মীর ছ’টি। ধান্যলক্ষ্মী, বীরলক্ষ্মী ও বিজয়লক্ষ্মীর আটটি করে। আর এঁরা প্রত্যেকেই পদ্মফুলের উপর ‘কমলে কামিনী’ হয়ে বসে থাকেন। বাংলায় যে লক্ষ্মীদেবীকে মা-কাকিমারা প্রতি বিষ্যুদবার সক্কালবেলায় পুজো করে থাকেন, তাঁরই একমাত্র দু’টি হাত। মানে, তিনি আমাদের ঘরের মেয়ে। তাঁর মাথার চুল সন্ধের বাতাসে ওড়ে। তাঁর হাত ধরে আলপথে সূর্যাস্তের কিছু আগে পায়ে পায়ে ঘুরে আসা যায়। গল্প করা যায় নদীর পারে, নদীজলে পা-ডুবিয়ে বসে। কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে যখন জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় চরাচর— তখন তিনি এই পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসেন।
বাংলার বিভিন্ন ছবি, সরা বা মূর্তিতে, একটি ফুটে থাকা পদ্মের উপর মা লক্ষ্মীকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখলেও, পেঁচাকে তাঁর বাহন হিসেবে ভারতবর্ষের আর কোথাওই দেখতে পাওয়া যায় না। আচ্ছা, আপনারা কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে, পেঁচাকে লক্ষ্মীর বাহন করার পিছনে আমাদের বাংলায় কত সুন্দর একটা ভাবনা জড়িয়ে আছে! আসলে, ধান তো লক্ষ্মীর প্রতীক। ধান খেতে থাকে ইঁদুর। ইঁদুর ধানের ক্ষতি করে। পেঁচা ধানখেতের ইঁদুর ধরে ধরে খায়। অর্থাৎ মানুষের ধনের রক্ষা করে। কিন্তু সে দিনের বেলায় অন্ধ আর রাতে জেগে থাকে। এর মানে আমরা যারা মা লক্ষ্মীর ভক্ত, তারাও যেন পরের ধনসম্পত্তি সম্বন্ধে এমন অন্ধই হয়ে থাকি। মানে, তাতে নজর না দিই। আর রাত্তিরে শুধু নিজের ধনসম্পত্তিটুকুই রক্ষণাবেক্ষণ করি, যাতে অন্য কেউ তার ক্ষতি না করতে পারে।
বাংলার লক্ষ্মীদেবীর গাল-ভরে সুনাম করলেও গুজরাতে এই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতেই এমন একটি প্রাচীন রীতির প্রচলন আছে, যা অবশ্যই আমাদের বাংলার লক্ষ্মীপুজোর নিয়মবিধির মধ্যে যুক্ত হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। গুজরাতি ভাইবোনেরা মনে করেন, চাঁদের আলো নাকি মানুষের শরীর ও মনকে তরতাজা করে। যেহেতু কোজাগরী পূর্ণিমায় আকাশের চাঁদ, পৃথিবীর খুব কাছাকাছি আসে, তাই ওই দিন ওখানকার প্রতিটি বাড়ির গৃহস্থ, একবাটি ঘন দুধের ক্ষীর বানিয়ে সারারাত চাঁদের আলোয় রেখে দেন। তার পর সকালে উঠে পবিত্র মনে তার সেবা করেন। বাংলার ব্রত ও পুজোপার্বণে কিছু কিছু আদিবাসী এবং বিদেশি রীতি রেওয়াজেরও প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন শিক্ষিত মনীষীরা। তা হলে লক্ষ্মীপুজোর দিনে, চাঁদ ও ক্ষীরের এই সুন্দর সংস্কারটি মানতে কোথায় কার সমস্যা হচ্ছে, তা আমার ছোট্ট মাথায় কিন্তু কিছুতেই ঢুকছে না!
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy