ছেলের ছবি সামনে রেখে মালা গাঁথছেন মালাদেবী।
দালান জুড়ে পড়ে রয়েছে লাল-নীল সুতো।ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জরি, প্লাস্টিকের ফুল।পুজোর এসব উপকরণে কালোর ঠাঁই নেই।সব কালো যেন বাসা বেঁধেছে শিল্পীর মনে।
ঘরের কাজে আর মনে বসেনা তাঁদের।হিসাবের খাতায় লেখা রয়েছে পুজোর বরাত।কিন্তু মালা গাঁথার ফাঁকে প্রৌঢ়ার আঁচলের খুঁট ভিজে যায় চোখের জলে।আগের মতো আর রোজ দোকানে যান না তাঁর স্বামী।পুজোর জামার জন্য এখন কেউ বায়না ধরেনা।নাড়ু তৈরির জন্যও তাড়া দেয় না কেউ।তাই কোনও কিছুতেই আর প্রাণ খুঁজে পান না বাপি মালাকার ও তাঁর স্ত্রী মালাদেবী।
কাটোয়ার দুর্গা গ্রামের মালাকার দম্পতির তিন ছেলেমেয়ে।বছর চারেক আগে শ্বশুর বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় বড় মেয়ে প্রিয়ার।বিষন্নতার সুর এসেছিল তখনই।আঁধার নেমে আসে গত বছর অক্টোবরে।চারদিকে তখন আলোর উৎসবের প্রস্তুতি।তারই মধ্যে বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় তাঁদের বছর কুড়ির ছেলে সৌরভের দেহ।হাতে আঁকা নীলতিমির ছবি, হাতে ফোটানো সূচ।
আরও পড়ুন: নোট ছাপার ফাঁকেই পুজো টাঁকশালে
দু’পুরুষ আগে মালার ব্যবসা শুরু করেছিল করজ গ্রামপঞ্চায়েতের দুর্গাগ্রামের এই মালাকার পরিবার।গ্রামে দশঘর মালা শিল্পীরবাস।বাপ-দাদার কাছে জরি, সুতো, মার্বেল পেপার দিয়ে প্রতিমার মালা তৈরি শিখেছিলেন বাপিবাবু।কাটোয়ার পঞ্চাননতলা বাজারে তাঁর দোকান।তিনি জানান, এ কাজে আগ্রহ ছিল ছেলে সৌরভেরও।
গত বছর অবধি বাবার সঙ্গে বড়বাজার থেকে জরি, প্লাস্টিকের ফুল-সহ সামগ্রী আনতে গিয়েছিল সে।বাপিবাবু বলেন, ‘‘লোহার ছাঁচে রঙিন মার্বেল পেপার, জরি সাজিয়ে মালা তৈরির নেশা ছিল ছেলের।পড়ার ফাঁকে প্লাস্টিকের কদম ফুলগুলি থার্মোকলের বল, উল দিয়ে বুনত।’’
দম্পতি জানান, দশম শ্রেণিতে ওঠার পরেই মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে ছেলে।তাকে পারিবারিক ব্যবসায় হাত লাগানোর পরামর্শ দিতেন তাঁরা।গত বছর বরাতের মালা কলকাতায় পৌঁছে দিতে ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরেছিলেন বাপিবাবু।রাস্তাতেই খবর পেয়ে ফিরে এসে দেখেন, ছেলে আর নেই।মোবাইলই কেড়ে নিল ছেলেকে, ঝাপসা চোখে সুতোয় পুঁথি গাঁথতে গাঁথতে আক্ষেপ করেন মালাদেবী।
আরও পড়ুন: উচ্চারণ ও পুজোর পাঠ দিতে কার্তিকের প্রশিক্ষণ
হুগলির শ্রীরামপুরে বিয়ে দিয়েছিলেন বড় মেয়ে, বছর উনিশের প্রিয়ার।সেখানেই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাঁর।বছর খানেক আগে ছোট মেয়ে পূজার বিয়ে দিয়েছেন মন্তেশ্বরে।এখন বাড়িতে শুধু প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া।বাপিবাবু জানান, বিশ্বকর্মা পুজো পেরোলেই নবদ্বীপ, আসানসোল, সাঁইথিয়া, বর্ধমানের নানা দোকানও পুজো উদ্যোক্তারা ৩০০-৪০০ ডজন মালার বরাত দিয়ে যান।কিন্তু এখন আর কাজে মন বসছে না।মালাদেবী বলে চলেন, ‘‘পুজো এলেই নতুন জামার বায়না করত ছেলে।
মালার বরাত বাবদ অগ্রিম পেলেই ওর হাতে টাকা দিতাম।’’ এখন আর নতুন জামার জন্য টাকা দেওয়ার তাড়া নেই।সৌরভ-প্রিয়ার প্রিয় নাড়ু তৈরির তোড়জোড়ও নেই।বাপিবাবু দাবি করেন, ‘‘মোবাইলে মারণ গেম আমার ছেলের প্রাণ নিয়েছে।এখনও তো শুনছি তেমন গেমের দৌরাত্ম্য এসব নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তরফে আরও সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা দরকার, যাতে আরও অনেকের কোল খালি না হয়।’’
এবছর দু’শো ডজন মালার বরাত এসেছে মালাকার দম্পতির কাছে।ছেলের ছবি সামনে রেখেই তা তৈরি করতে বসেছেন দম্পতি।তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের প্রাণের দুই ফুলই তো শুকিয়ে গেল।দেবীর মালা গাঁথায় মন বসাব কী করে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy