Advertisement
Kali Puja 2020

শ্মশানবাসিনী থেকে আদরিনী শ্যামা: কলকাতার বনেদি বাড়ির কালী পুজো

দুর্গোৎসবের মতোই কলকাতার বনেদি পরিবারেগুলির কালীপুজোয় দেখা যায় হরেক বৈচিত্র।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২০ ১৩:৫৪
Share: Save:

পুজো শুরু করেছিলেন শিবকৃষ্ণ দাঁ ১৮৪০-এ।

তিনি শ্মশানবাসিনী, করালবদনী। গলায় তাঁর শোভা পায় মুণ্ডমালা। তাঁর এক হাতে খড়গ, অন্য হাতে মুণ্ড। তেমনই অন্য দুই হাতে বর ও অভয় মুদ্রা। রামপ্রসাদ সেন, শ্রীরামকৃষ্ণ, বামাখ্যাপা কিংবা কমলাকান্তের হাত ধরেই শ্মশানবাসিনী কালীর প্রবেশ ঘটেছিল বাঙালির ঘরে। কলকাতা কালীক্ষেত্র। নবমীর রাত পোহালেই যে আলো ম্লান হয়ে আসে, কালীপুজোয় আবারও ঘোর অমানিশা আলোকিত হয়ে ওঠে সেই মহাশক্তির আরাধনায়। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন দেবী কালী। দুর্গোৎসবের মতোই কলকাতার বনেদি পরিবারেগুলির কালীপুজোয় দেখা যায় হরেক বৈচিত্র।

শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ি (জোড়াসাঁকো) পুজো শুরু করেছিলেন শিবকৃষ্ণ দাঁ ১৮৪০-এ। এখানে প্রতিমার গায়ের রং গাঢ় বেগনি। বৈষ্ণব পরিবার বলে কোনও বলিদান হয় না। অন্নভোগ না হলেও থাকে লুচি, ভাজা, তরকারি, মিষ্টি। পুজোয় আজও বাজি পোড়ানো হয়।

মার্বেল প্যালেস (মুক্তরামবাবু স্ট্রিট) সাবেক চোরবাগান অঞ্চলে প্রাসাদোপম এক বাড়িতে ১৮৪০ সালে পুজো শুরু করেছিলেন রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক। ঐতিহ্য মেনেই প্রতিমার সাবেক সৌম্য রূপটি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতিমার সাজেও আছে সাবেক ছোঁয়া। শোলার উপর অভ্রের চুমকি দিয়ে প্রতিমার সাজ তৈরি করা হয়। প্রতিমার চালি গোলাকৃতি। চার পুরুষ ধরে প্রতিমার অঙ্গরাগ ও সাজানোর কাজ করছেন বাগনানের কাশীনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবার। বংশ পরম্পরায় প্রতিমা গড়েন মৃৎশিল্পী। তেমনই ডোমজুর থেকে পাঁচ পুরুষ ধরে আসেন ঢাকিরা। বৈষ্ণব পরিবার বলে পুজোয় কোনও বলিদান হয় না। পুজোয় উৎসর্গ করা হয় ১০৮টি প্রদীপ। ভোগে থাকে ময়দার লুচি, ভাজা, দই, রসকরা, তবক দেওয়া সন্দেশ, চন্দনীক্ষীর। এ ছাড়াও পুজোয় তালের ফোঁপল ও করবী ফুল দেওয়া হয়, যা আনা হয় বাড়ি সংলগ্ন নীলমণি নিকেতন থেকে। প্রতিপদের দিন বাহকের কাঁধে চেপে আজও প্রতিমা বিসর্জনে যান।

পারিবারিক প্রথা অনুসারে অমাবস্যা তিথি যখনই পড়ুক, রাত দশটার সময় পুজো শুরু হয়।

দত্তবাড়ি (চোরবাগান) শোনা যায়, পরিবারের আদি নিবাস ছিল গোবিন্দপুরে। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ তৈরির সময় এই পরিবারের আদিপুরুষ দুর্গাচরণ দত্ত চোরবাগান অঞ্চলে নিষ্কর জমিতে বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেন এবং পারিবারিক পুজোপার্বণগুলি স্থানান্তরিত করেন। পারিবারিক প্রথা অনুসারে অমাবস্যা তিথি যখনই পড়ুক, রাত দশটার সময় পুজো শুরু হয়। পুজোর আগে একটি নৈবেদ্য পাঠানো হয় ঠনঠনে কালীবাড়িতে। দেবীকে পরানো হয় সোনা-রুপোর গয়না। ভোগে থাকে লুচি, তরকারি, ভাজা ও নানা রকমের মেঠাই।

আরও পড়ুন: বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো

বৈষ্ণবদাস মল্লিকের বাড়ি (দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট)— অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে সে কালের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং ওরিয়েন্টাল সেমিনারি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বৈষ্ণবদাস মল্লিক এই পুজো শুরু করেন। চালি গোলাকৃতি। পুজোয় কারণ ব্যবহার হয় না। ভোগে থাকে লুচি, পাঁচ রকম মিষ্টি, সাদা মাখন, ক্ষীর ইত্যাদি। পারিবারিক প্রথা মেনে ঠাকুরদালানের মেঝেতে বালি দিয়ে ভিতকে সাক্ষী রেখে হোম করা হয়।

সাবেক রীতির দক্ষিণা কালীর মূর্তি ডাকের সাজে সজ্জিত, পিছনে থাকে গোলাকৃতি চালি।

রামদুলাল নিবাস (বিডন স্ট্রিট) সেকালের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী রামদুলাল সরকার 'শিপ সরকার' নামেই পরিচিত ছিলেন। মূল পদবি দে, কিন্তু রামদুলাল ‘সরকার’ নামেই পরিচিত ছিলেন। তিনি সিমলা অঞ্চলে প্রাসাদোপম এক বাড়ি নির্মাণ করে ১৭৮০ সালে শুরু করেন বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো। ছাতুবাবু ও লাটুবাবু নামে পরিচিত তাঁর দুই পুত্রের আমলে এই পরিবারের সমৃদ্ধি ঘটে। কালীপুজোর দিন, পরিবারের কূলদেবতা শ্রীধর জীউর সামনে হয় অলক্ষ্মী বিদায়ের পর্ব ও লক্ষ্মীপুজো। তার পর শুরু হয় কালীপুজো। সাবেক রীতির দক্ষিণা কালীর মূর্তি ডাকের সাজে সজ্জিত, পিছনে থাকে গোলাকৃতি চালি। কাঠের সিংহাসনে দেবীর অধিষ্ঠান। সামনে থাকে ঝুলন্ত অভ্রধারা।

কালীপুজোয় ১০৮টি জবার পরিবর্তে নীল অপরাজিতা দেওয়া হয়।

রাধাকৃষ্ণ মিত্রের বাড়ি (দর্জিপাড়া)— নীলমণি মিত্রের পৌত্র প্রাণকৃষ্ণ ছেলেবেলায় খেলার ছলে মাটি দিয়ে কালীমূর্তি গড়েছিলেন। কিন্তু তাতে ভুলবশত কালী প্রতিমার বাঁ পা শিবের বুকে ছিল। সেই থেকেই এ বাড়ির কালীপুজোর শুরু। আজও সেই প্রথা মেনে দেবীর বাঁ পা শিবের বুকে থাকে। কালীপুজোয় ১০৮টি জবার পরিবর্তে নীল অপরাজিতা দেওয়া হয়। অন্যান্য বৈচিত্রের মধ্যে পুজোয় থাকে মাখনের নৈবেদ্য। তার উপরে থাকে পানের খিলি।

আরও পড়ুন: উৎসবের মরসুমে সঙ্গীর মনে আলো জ্বালতে কী কী করতেই হবে

প্রামাণিক বাড়ি (তারক প্রামাণিক রোড) ২০০ বছর আগে পুজো শুরু করেছিলেন তারকনাথ প্রামাণিক। আগে প্রতি বছর কালীপুজোয় ১০৮টি করে সোনার বেলপাতা ও জবা ফুল পুজোয় দেওয়া হত। পুজোয় চাল ও ফলের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। ডাকের সাজের সাবেক প্রতিমা। কুমারী পুজো হয়। উল্লেখযোগ্য এই যে, কালীপুজোর পরের দিন প্রতিপদে কাঁটা-বাটখারা ইত্যাদি লোহার যন্ত্রের উপর বিশেষ কালীপুজো করা হয়

সাবেক বাংলা শৈলীর প্রতিমা রুপোলি ডাকের সাজে সজ্জিত।

হাটখোলার দত্তবাড়ি (নিমতলা ঘাট স্ট্রিট)— আন্দুল দত্তচৌধুরী পরিবারের রামচন্দ্র দত্ত অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে হাটখোলায় বসতি স্থাপন করে দুর্গোৎসব ও কালীপুজো শুরু করেন। মদনমোহন দত্ত লেনের পুরনো বাড়িতে এখনও সেই পুজো হয়। পরবর্তী কালে রামচন্দ্রের পৌত্র জগৎরাম দত্ত নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে এক প্রাসাদোপম গৃহ তৈরি করে পুজো শুরু করেন। সাবেক কাঠের সিংহাসনে দেবীর অধিষ্ঠান। সাবেক বাংলা শৈলীর প্রতিমা রুপোলি ডাকের সাজে সজ্জিত। বিসর্জনের আগে প্রতিমা বরণ করেন বাড়ির কুমারী মেয়েরা। ভোগে থাকে লুচি এবং নানা ধরনের মিষ্টি।

বউবাজার মতিলালবাড়ি (দুর্গা পিতুরি লেন)— জয়নগর-মজিলপুরের মতিলাল পরিবারের বিশ্বনাথ মতিলাল পিতৃহীন হয়ে মাতুলালয়ে চলে এসেছিলেন। পরে সরকারি নুনের গোলার সামান্য চাকুরে থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ বিভাগের দেওয়ান হন। পরবর্তী কালে তিনি মামার সম্পত্তি লাভ করে পুজোর ভার গ্রহণ করেন। এখানকার প্রতিমা শ্যামাকালী। পুজো হয় বৈষ্ণবরীতি মেনে। ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, মাছের মুড়ো দিয়ে ডাল, ছ্যাঁচড়া, লাউ চিংড়ি, নানা ধরনের মাছ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন: উৎসবের মরসুমে বাড়িতে ধূপ-ধুনো? কোভিড আবহে ফল হতে পারে মারাত্মক

ভবানীপুর মিত্রবাড়ি (পদ্মপুকুর রোড)— ১৮৯২-এ পুজো শুরু করেন অ্যাটর্নি সুবোধচন্দ্র মিত্র। সাত পোয়া মাপের প্রতিমাকে পরানো হয় ডাকের সাজ। প্রতিমার কানে থাকে দু’টি শিশুর শব মূর্তি। দেবীর কপালে আঁকা থাকে উল্কি এবং বাঁ পায়ে আঁকা থাকে বিছে। ভোগে দেওয়া হয় লুচি, তরকারি ও নানা ধরনের মিষ্টি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kali Puja 2020 Diwali 2020 Diwali Celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE